স্বাধীন বাংলাদেশে শিল্পক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেননি শুধু, সমৃদ্ধিশালী জাতি গঠনে রেখে গেছেন অনন্য, অতুলনীয় অর্থনৈতিক দর্শন। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া নতুন সংবিধানে দারিদ্র্য মুক্তির চমৎকার পথনির্দেশনা দিয়েছেন। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে বলিষ্ঠ কণ্ঠে ব্যক্ত করেছেন প্রতিশ্রুতি। গরিব-দুঃখী সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ গ্রামের পরিশ্রমী কৃষক যারা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে অনেক খেটে ফসল ফলান তাদের সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজের দেওয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ছিলেন নির্ভীক। আজ এত বছর পরও বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনকে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তার চিন্তা-চেতনায় এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং স্বয়ম্ভরতা অর্জন ছিল মূল কেন্দ্রবিন্দু।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ১৯৭২-৭৩ সালে বহির্বিশ্বের পরিস্থিতিও ছিল চরম প্রতিকূল। সমুদ্রবন্দরে যেসব জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে, এগুলো অপসারণ না করলে বিদেশী জাহাজ তীরে ভিড়তে পারছে না। দেশের কলকারখানায় পাকিস্তান আমলে তৈরি পণ্য বিদেশে পাঠানো যাচ্ছে না। কাঁচামালও আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ সময় বিশ্ব পরিস্থিতিও চরম প্রতিকূল ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই মার্কিন প্রশাসন ‘স্মিথসোনিয়ান এগ্রিমেন্ট’ বাস্তবায়ন করে, অর্থাৎ স্বর্ণ থেকে ডলারকে পরিবর্তন করার যে সমীকরণ ছিল, তা রহিত করা হয় এবং ফলে পুরো বিশ্বে এবং উন্নত অর্থনীতিগুলোর অনেকগুলোয় আন্তর্জাতিকভাবে নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। এ সময়ে বিশ্ববাজার পরিস্থিতি ছিল অস্থিতিশীল এবং আমদানি ব্যয়ও ছিল অত্যধিক। বিশ্ববাজারে শস্য ও সারের মূল্য তিন গুণে উন্নীত হয় এবং প্রায় সারা বিশ্বে নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। যুদ্ধের বছরে প্রায় কোনো ফসলই ফলেনি। আর স্বাধীনতার পরের বছরও পূর্ণাঙ্গ চাষাবাদ শুরু করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা শ্রমিক জনতার স্বার্থে পরিত্যক্ত শিল্প কারখানাগুলোকে জাতীয়করণ করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যবস্থাপকদের দক্ষতার অভাবে কারখানাগুলো অলাভজনকে পরিণত হয়।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের পরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুবই নাজুক ছিল। ১৯৭০-এর বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কা (যাতে প্রায় আড়াই লক্ষ বাঙালির মৃত্যু হয়) কাটিয়ে না উঠতেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের কারণে দেশটির কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও পরিবহন খাতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। নতুন এই দেশের জনঘনত্ব ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উচ্চ ছিল এবং এর সিংহভাগ নাগরিকই ছিল নিরক্ষর, অপ্রশিক্ষিত ও বেকারত্বের শিকার। যুদ্ধের কারণে দেশের আবশ্যকীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার প্রায় ফুরিয়ে যায়। নবপ্রতিষ্ঠিত দেশে কাজে লাগানোর মতো প্রাকৃতিক সম্পদও ছিল অপ্রতুল। ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারী প্রায় ১ কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনও ছিল এক বিরাট সমস্যা। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ - যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস’ সরকারের রুপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড় অর্জন। শিল্পক্ষেত্রে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। মূলত তা বঙ্গবন্ধুর অবদান। তিনি যদি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) প্রতিষ্ঠা না করতেন, তাহলে আজ দেশ শিল্পে এগিয়ে যেতে পারতো না। এছাড়া মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে এদেশের প্রত্যেক মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে বিদ্যুৎ, কৃষি ও সমবায়, শিল্প ও বিজ্ঞান, গৃহনির্মাণ, অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা, শিল্প ব্যবস্থাপনা জাতীয়করণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছিলেন তিনি। আজও এ দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো কাজ করতে গেলে আমরা দেখতে পাই হয় প্রতিষ্ঠানটি জাতির পিতা নির্মাণ করে দিয়ে গেছেন, না হয় প্রতিষ্ঠানটির যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায়জাত করা হয়েছে তার শুরুটা জাতির পিতা করে দিয়ে গেছেন। তিনি অসংখ্য নীতি, পরিকল্পনা ও আইনের উদ্যোক্তা।
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের কিছু মধ্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল প্রথমত, স্বনির্ভরতা, যতটা সম্ভব দেশের সম্পদ ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, বিদেশ ও দাতাদের কাছ থেকে শর্তহীন অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে স্বাগত জানানো এবং ক্রমান্বয়ে এ ধরনের নির্ভরতা হ্রাস করা। তৃতীয়ত, ১৯৭৪ সালের শুরুতেই বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সীমা ২৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা হয়। কাজেই বেসরকারি খাতকে বঙ্গবন্ধু উপেক্ষা করেছেন, এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না। উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও দুর্নীতি হ্রাস, উন্নয়নের জন্য সম্পদ সংগ্রহ। এটাই হলো বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের মূল কথা।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলায় শিল্পক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪০ কোটি টাকার বেশি। কাঁচামাল, বস্তুগত অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি এ ধ্বংসলীলার শিকার হয়। সরকারি খাতের অন্তর্গত পাটশিল্প, শিপইয়ার্ড ও ডিজেল প্লান্ট ইত্যাদির পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। এছাড়া বেসরকারি খাতের হাজার হাজার কুটিরশিল্প ধ্বংস হয়ে যায় যুদ্ধের ধ্বংসলীলায়। এ ক্ষতি পূরণের জন্য জাতির পিতা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রপাতি জোগানের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন। তিনি ১৯৭২-৭৩ সালের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন ৫৭৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি ফ্যাক্টরি, মেশিনপত্র, গুদাম ইত্যাদি মেরামতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণদান, মূলধন বিনিয়োগে ‘ইকুইটি’ সহযোগিতা, কাঁচামাল ক্রয়, কারখানা চালু রাখতে ব্যয় সংকুলানের জন্য চলতি মূলধন বাবদ স্বল্পমেয়াদি ঋণ, আমদানিকৃত ও স্থানীয় কাঁচামাল নিয়মিত সরবরাহ, সেক্টরভিত্তিক সংস্থাগুলোর অধীনস্থ কলকারখানা ও উৎপাদন যন্ত্রগুলো সক্রিয় করার ব্যবস্থা করেন। আমরা এখন সাত শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলি। অথচ বঙ্গবন্ধুর সময়ই বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। তিনি তখনই বলতেন, বাংলাদেশ চিরদিন অনুন্নত থাকতে পারে না।
No comments:
Post a Comment